আফগানিস্তান
আফগানিস্তান দক্ষিণ এশিয়ার একটি ঐতিহ্যশালী স্বাধীন রাষ্ট্র যার সরকারি নাম, আফগানিস্তান ইসলামি প্রজাতন্ত্র। কাবুল দেশটির রাজধানী ও বৃহত্তম একটি শহর, এছাড়াও অন্যান্য উল্লেখযোগ্য শহর গুলির মধ্যে রয়েছে কান্দাহার, হেরাত, মাজারে শরীফ, গাজ্নি, জালালাবাদ, চারিকার, খোস্ত, কন্দোজ ও ফয়েজাবাদ। ০৬,৫২,২৩০ বর্গ কিলমিটার আয়তনের এই দেশটি, আয়তনের দিক থেকে পৃথিবীর ৪১তম বৃহত্তম দেশ । দেশটির পূর্ব থেকে পশ্চিম প্রান্তের সর্বোচ্চ দূরত্ব ১,২৪০ কিমি বা ৭৭০ মাইল এবং উত্তর থকে দক্ষিণ প্রান্তের সর্বোচ্চ দূরত্ব ১,০১৫ কিমি বা ৬৩০ মাইল ।
সাগর বিহীন এই দেশটি উত্তর দিকে রেছে তুর্কমেনিস্তান, উজবেকিস্থান
ও তাজিকিস্তান। এবং দক্ষি্ণ ও দক্ষিণ-পশ্চিম দিকে রয়েছে পাকিস্তান , পূর্ব দিকে চীন ও পশ্চিমে ইরান অবস্থিত। এই ৬টি
প্রতিবেশী দেশের সাথে আফগানিস্থানের সর্বমোট ৫৯৮৭ কিলোমিটরের বর্ডার রয়েছে, এর মধ্যে
সবচেয়ে বড় বর্ডারটি রয়েছে পাকিস্থানের সাথে ২৬৭০ কিলোমিটার, এর পরের দীর্ঘ বর্ডারটি
রয়েছে তাজিকিস্তানের সাথে ১৩৫৭ কিলোমিটারের। ইরানের সাথে রয়েছে ৯২১ কিলোমিটার, এছাড়াও
তুর্কমেনিস্তানের সাথে ৮০৪ কিলোমিটার, উজবেকিস্তানের সাথে ১৪৪ কিলোমিটার এবং সবচেয়ে
ছোট বর্ডারটি রয়েছে চীনের সাথে মাত্র ৯১ কিলোমিটারের।
আফগানিস্তানের প্রত্নতাত্ত্বিক স্থান খনন করে দেখা গিয়েছে যে, আজ
থেকে প্রায় ৫০,০০০ বছর আগেও বর্তমান দেশটির উত্তর অংশে মনুষ্যবসতি গড়ে ওঠেছিল। ধারণা
করা হয় আফগানিস্তানের মাটিতে গড়ে ওঠা এই মানুষ্য বসতি বিশ্বের প্রাচীনতম মনুষ্যবসতি
গুলোর মধ্যে একটি ছিল। আফগানিস্তান শব্দের অর্থ হল অফগান/পাশতু জাতিদের দেশ। তবে বর্তমানে
আফগান বলতে কেবল পশতু নয়, বরং জাতি নির্বিশেষে দেশের সকল নাগরিককেই বোঝায়।
আফগানিস্তান মূলত একটি মুসলিম সংখ্যা গরিষ্ঠ দেশ, এদেশের ৯৯.০৭ শতাংশ
মানুষই ইসলাম ধর্মের আনুসারী। বর্তমান আফগানিস্তানের জনসংখ্যা প্রায় ৩ কোটি ৭৪ লাক্ষ
৬৬ হাজার ৪১৪ জন। এদের মধ্যে ৪২ % ই পাশতু জাতি সম্প্রদায় , এছাড়া এর পাশাপাশি ২৭
% তাজিক, উজবেখ ও হাজারা ৯%, আইমাক ৪%, তুর্কমেন ৩%, বালুচ ২% এবং ৪% অনান্য জনগোষ্ঠির
অন্তর্গত মানুষের বসবাস এই দেশটিতে।আতীতে আফগানিস্তানের এই সকল মানুষদের পূর্বপুরুষেরা
বর্তমান ইরান, পাকিস্তান, তাজিকিস্তান, তুর্কমেনিস্তান, উজবেকিস্তান, কিরগিজস্তান, মঙ্গোলিয়া, চীন,
আরব উপদ্বীপ ও আরও বহু জায়গা থেকে এখানে এসে স্থায়ী বসতি স্থাপন করে ছিলেন। শতাব্দীর
পর শতাব্দী ধরে এই সকল মানুষের বসবাসের ফলে দেশটিতে সৃষ্টি হয়েছে বিপুল ভাষা ও জাতিগত
বৈচিত্র্য।
পশতু ও দারি আফগানিস্তানের সরকারী ভাষা, দেশের অধিকাংশ মানুষই এই
দুইটি ভাষাই কথা বলে থাকে, এই দুইটি ভাষা ছাড়াও
আরোও অসংখ্য ভাষার প্রচলন রয়েছে এদেশে…. উজবেক, তুর্কমেন, খোরাসানি তুর্কি ভাষা দেশের উত্তরের সমভূমিতে বহুল প্রচলিত, পশতু ভাষা দেশটির মধ্যভাগে পূর্ব থেকে পশ্চিম প্রান্ত পর্যন্ত বিস্তৃত, এই পশতু ভাষা অঞ্চলের উত্তরে দারি এবং দক্ষিণে বালুচি ভাষা প্রচলিত। এবং কাবুল থেকে উত্তর-পূর্বে চীন সীমান্ত পর্যন্ত দার্দিক, নুরিস্তানি ও পামির ভাষাগুলির প্রচলন রয়েছে।
আফগানিস্তান একটি রুক্ষ এলাকা যার অধিকাংশ জায়গা পর্বত ও মরুভূমি দ্বারা আবৃত। উত্তর-পশ্চিম, পশ্চিম ও দক্ষিণের সীমান্তবর্তী এলাকাগুলি মূলত মরুভূমি ও পর্বতশ্রেণী। এই পর্বতশ্রেণী গুলি ক্রমশ উত্তর দিকে উঁচু হয়ে তুষার-ঢাকা পশ্চিম হিমালয়ের হিন্দুকুশ পর্বতমালার সাথে মিলিত হয়েছে, হিন্দু কুশ পর্বতমালার অধিকাংশই এই দেশের অন্তর্গত। এই হিন্দুকুশ
পর্বতের উত্তর-পূর্ব সীমান্তে রয়েছে আফগানিস্তানের সর্বোচ্চ পর্বতশৃঙ্গ নওশাক যেটি সমুদ্রপৃষ্ঠ থকে ৭,৪৮৫ মিটার উচুতে অবস্থিত । আফগানিস্তানের বেশির ভাগ নদ-নদী গুলির উৎপত্তি পার্বত্য জলধারা থেকে, ১১৫০ কিলোমিটার ব্যপী হেলমন্দ নদী আফগানিস্তানের দীর্ঘতম নদী,
এছাড়াও অনান্য নদী গুলির মধ্যে আমু দরিয়া, হারি রুদ, কাবুল নদী বিষেশ উল্লেখযোগ্য।
দেশের গ্রীষ্মকালীন আবহাওয়া গরম ও শুষ্ক প্রকৃতির এবং শীতকালে প্রচণ্ড শীত পড়ে। এখানকার গ্রীষ্মকালীন গড় তাপমাত্রা ৩৫ থেকে সর্বোচ্চ ৪৬ ডিগ্রি এবং শীতকালীন
গড় তাপমাত্রা -১ থেকে সর্বনিম্ন -২০ ডিগ্রি পর্যন্ত অবস্থান ভেদে ওঠানামা করে থাকে,
এবং বাষিক গড় বৃষ্টিপাতের পরিমান ৩৮০ মিলিমিটার। দেশটির মাত্র ১ শতাংশ এলাকা বনাঞ্চল, এবং এগুলি মূলত আফগানিস্তানের পূর্ব ও দক্ষিণ-পূর্ব দিকে রয়েছে। আফগানিস্তানের উদ্ভিদ ও প্রানীর সংখ্যা খুবই অল্প কিন্তু তা বিচিত্রপূর্ন।
আফগানিস্তান মূলত কৃষি ও পশুপালনের উপর নির্ভর একটি দুর্বল অর্থনীতির দেশ। এর প্রধান কারন,
কয়েক দশক ধরে চলতে থাকা আফগানিস্তানের যুদ্ধ সমূহ। দেশের প্রায় অর্ধেক মানুষের প্রধান
জীবিকা কৃষিকাজ ও পশুপালন, এমনকি এই দেশের ৫০%
মানুষ-ই দরিদ্র সীমার নিচে বসবাস করে।
গম আফগানিস্তানের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ শস্য গুলোর মধ্যে একটি। এছাড়াও যব, ভুট্টা, ধান তুলা, বাদাম, বাজরা, আলু, আখ, তরমুজ,
আঙ্গুর, আপেল, তামাক, পোস্ত, রেশম প্রভৃতির উৎপাদন হয়ে থাকে দেশটিতে। আফগানিস্তান থেকে যে সকল পন্য গুলি সবচেয়ে বেশি পরিমানে বিদেশে রপ্তানি করা হয় সেগুলি
হল…… বিভিন্ন প্রাকার ফল ও বাদাম, কিশমিশ, তুলা, রেশম,
কার্পেট, বহু মূলবান রত্নপাথর এবং নানান প্রকারের ভেষজ উদ্ভিদ । অপর দিকে তেমনি আফগানিস্তান
অনান্য দেশ থকে নানান প্রকার যন্ত্রপাতি ও খাদ্য সামগ্রী, টেক্সটাইল এবং পেট্রোলিয়াম
মত পণ্য গুলি আমদানি করে থাকে। ২০১৭ সালে আফগানিস্তানের সমগ্র আমদানি করা পন্যের মূল্য
যেখানে ছিল ৭.৬১৬বিলিয়মন মার্কিন ডলার, সেখানে দেশটি রপ্তানি করে ছিল মাত্র ৭৮৪ মিলিয়ন
মার্কিন ডলারের পন্য সামগ্রী।
২০১৯ সালে রির্পোট অনুযায়ী আফগানিস্তানের জিডিপির পরিমান- ১৯.০১
বিলিয়ন মার্কিন ডলার। এদেশের জিডিপির ২৩%-ই এসে থাকে কৃষিখাত থকে, এর পাশাপাশি শিল্প
খাত থকে ২১.১%, এবং পন্য ও পরিষেবা খাত থেকে এসে থাকে ৫৫.০৯ %।
আফগানিস্তান খনিজ সমৃদ্ধ দেশ গুলোর মধ্যে একটি, দেশটিতে আনুমানিক ১৪০০-র অধিক বিভিন্ন খনিজ ক্ষেত্র রয়েছে। এই সকল খনিজ ক্ষেত্রগুলোর আনুমানিক মূল্য ১ থেকে ৩ ট্রিলিয়ন মার্কিন ডলার। কিছু তথ্য অনুযায়ী সেটা সাত ট্রিলিয়ন মার্কিন ডলার পর্যন্ত হতে পারে।
যুক্তরাষ্ট্রের ভূতাত্ত্বিক জরিপ ইউএসজিএস এর গবেষণা অনুযায়ী, আফগানিস্তানে ৬০ মিলিয়ন মেট্রিক টন তামা, ২.২ বিলিয়ন টন লোহা, ১.৪ মিলিয়ন টন দুর্লভ বস্তু - যেমন ল্যান্থানাম, সেরিয়াম, নিউডিমিয়াম, অ্যালুমিনিয়াম রয়েছে।
এছাড়াও অনান্য খনিজ সম্পদ গুলির মধ্যে রয়েছে কয়লা সীসা, অভ্র, ক্রোমাইট,
সোনা, রূপা, খনিজ তেল এবং প্রাকৃতিক গ্যাসের মত বহু মূল্যবান খনিজ সম্পদ। সেই সঙ্গে রয়েছে উচ্চ মানের পান্না, রুবি, নীলকান্তমণি, ইত্যাদি রত্ন-পাথরের মজুদও।
তবে দেশটিতে সবচয়ে বেশি পরিমানে মজুত রয়েছে লিথিয়ামের, আফগানিস্তানে
যে পরিমান লিথিয়ামের মুজত রয়েছে তা যদি সঠিক ভাবে উত্তোলন করা সম্ভব হয় তাহলে দেশটির
অর্থনীতি বদলে যেতে পারে একপকেই । এমনকি আফগানিস্তান পরিনত হতে পারে লিথিয়ামের সৌদি
আরব-এ।
কোন মন্তব্য নেই
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন